মানবিক কারণে ফেনী নদীর পানি দেয়া: পররাষ্ট্র সচিব
তিস্তার পানি ভাগাভাগি নিয়ে কোনও চুক্তি প্রধানমন্ত্রী হাসিনার এবারের দিল্লি সফরেও হল না। তবে আরও সাতটি অভিন্ন নদীর পানিবন্টনের জন্য দুই দেশ যে একটি ফ্রেমওয়ার্ক প্রস্তুত করতে রাজি হয়েছে সেটাকে যথেষ্ট ইতিবাচক লক্ষণ বলে মনে করছে ঢাকা। সম্পূর্ণ মানবিক কারণেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শনিবার (৫ অক্টোবর) দিল্লিতে সাংবাদিকদের এ কথা জানান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব এম শহীদুল হক।দুদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী ফেনী নদী থেকে ১.৮৬ কিউসেক পানি ত্রিপুরার সাব্রুম শহরে সরবরাহ করা হবে, যাতে ওই অঞ্চলে পানীয় জলের প্রয়োজন মেটানো যায়।
ভারতের বিতর্কিত জাতীয় নাগরিকপঞ্জী বা এনআরসি নিয়ে ঘটনাপ্রবাহ কোন দিকে গড়ায়, সে দিকেও বাংলাদেশ সতর্ক নজর রাখছে বলে তিনি জানান।
দিল্লিতে দিনভর ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ও প্রতিনিধি স্তরে যেসব বৈঠক হয়েছে তা অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে বলেও দাবি করেন এ কর্মকর্তা।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব এম শহীদুল হক শনিবার রাতে সাংবাদিকদের বলেন, যেহেতু দুদেশের যৌথ নদী কমিশন বা জেআরসি বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই আলোচনা শুরু করেছে, তাই তিস্তা নিয়েও আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। যেহেতু যৌথ নদী কমিশন প্রায় ছয় বছর পর বৈঠকে বসেছে, আগামী বছর আবার বসবে- তাই আমরা কিন্তু আশা করতেই পারি। আর তারা সবগুলো কমন রিভার (অভিন্ন নদী) নিয়েই কাজ শুরু করেছে। আর কমিশন শুধু এই অভিন্ন নদীগুলোর পানিবন্টন না, উন্নয়নের বণ্টন নিয়েও ভাবছে। কারণ সারা বিশ্বেই জলসম্পদ এখন আলোচনার একেবারে ওপরের দিকে।
তিনি বলেন, সেই পটভূমিতেই আমরা তিস্তাসহ সব অভিন্ন নদীকেই একটা বৃহত্তর ফ্রেমওয়ার্কে ভাবছি, যেখানে শিপিং থেকে শুরু করে বেসিন ম্যানেজমেন্ট সব কিছু নিয়েই আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এদিকে, বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়াতে এরিমধ্যেই অনেকে লেখালেখি শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ এবারও তিস্তার পানি পেল না, সেখানে কেন আগ বাড়িয়ে ভারতকে ফেনী নদীর পানি দিয়ে আসা হল?
সীমান্ত দিয়ে বয়ে চলা ফেনীর পানি পেলে ওই অঞ্চলের মানুষের জলকষ্ট মিটবে, ভারতের এই অনুরোধের পটভূমিতেই প্রধানমন্ত্রী হাসিনা সম্পূর্ণ মানবিক কারণে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
পররাষ্ট্রসচিব এম শহীদুল হক বলেন, আমার মনে হয় মানবিক ইস্যুর সঙ্গে আর কোনও ইস্যুকে মেশানো কিছুতেই ঠিক নয়। দক্ষিণ ত্রিপুরার ওই অঞ্চলটাতে খাবার পানি নেই। আর সে কারণেই কিন্তু আমরা পানি দিয়েছি। আর আমরা যদি পানি না দিতাম, তাহলে কি কারবালার মতো হয়ে যেত না? পাল্টা প্রশ্ন ছোড়েন তিনি।
তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে ২০১১ সালে দুই দেশের সরকার যে অন্তর্বর্তী চুক্তির কাঠামোয় একমত হয়েছিলো কবে তার বাস্তবায়ন হবে বাংলাদেশের জনগণ অধীর আগ্রহে সেই অপেক্ষায় আছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আবার স্মরণ করিয়ে দেন একই কথা।
তবে এবারের সফরে সাতটি চুক্তি সই হলেও বহুল প্রত্যাশিত সেই তিস্তা চুক্তি নিয়ে আলাদা কোনো সমঝোতা বা চুক্তি হয়নি।
নয়াদিল্লির হায়দ্রাবাদ হাউসে শনিবার দুপুরে বৈঠক বসেন শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি। বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতিতে দেয় দু’দেশ। বিবৃতিতে জানানো হয়, তিস্তা চুক্তির বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, তার সরকার তিস্তায় সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের (স্টেকহোল্ডার) সঙ্গে নিরন্তর কাজ করে চলেছে, যাতে যত দ্রুত সম্ভব এ তিস্তা চুক্তি সম্পাদন করা যায়।
এবার নতুন যেটা তা হল, তিস্তা ছাড়াও আরও ছয়টি অভিন্ন নদীর (মনু, মুহুরি, খোয়াই, গোমতী, ধরলা, দুধকুমার) পানি কীভাবে ভাগাভাগি করা যায়। এবারে বৈঠকে অবিলম্বে তার একটি খসড়া কাঠামো প্রস্তুত করতে দুই নেতা যৌথ নদী কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছেন। এ ছাড়াও ফেনী নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়েও অন্তর্বর্তী চুক্তির কাঠামো তৈরি করতে কমিশনকে বলা হয়েছে।
ভারত ও বাংলাদেশের কর্মকর্তারা দাবি করেন, এই সাতটি অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে যে দ্বিপাক্ষিক ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করা হচ্ছে - সেই একই ফর্মুলা ভবিষ্যতে তিস্তার ক্ষেত্রেও কাজে লাগানো যেতে পারে।
বৈঠকে দু'দেশের মধ্যে সাতটি সমঝোতা স্মারক সই হয় এবং ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দুই দেশের নেতারা তিনটি প্রকল্পের উদ্বোধন করেন।
টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর এটাই শেখ হাসিনার প্রথম দিল্লি সফর। এর আগে ২০১৭ সালে তিনি সর্বশেষ দিল্লি সফর করেন।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন:
যৌথ বিবৃতিতে রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি, বলা হয়েছে 'মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে আশ্রয়চ্যুত মানুষজন'।
এ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে ভারত আরও সক্রিয় ভূমিকা রাখুক, মিয়ানমারের ওপর আরও বেশি করে তাদের প্রভাব খাটাক - বাংলাদেশ এই অনুরোধ জানিয়ে আসছে বহু দিন ধরে।
দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের দ্রুত ও নিরাপদ প্রত্যাবাসনের পথ প্রশস্ত করতে যে অধিকতর প্রয়াস দরকার, তারা সে ব্যাপারে একমত হন।
মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের নিরাপত্তা পরিবেশ ও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটিয়েই যে সেটা করতে হবে, সে কথাও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
ভারত যে রাখাইন প্রদেশে ইতোমধ্যেই ২৫০ বাড়ি বানিয়েছে এবং ফিরতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের জন্য সেখানে আরও বাড়ি নির্মিত হচ্ছে সেটাও উল্লেখ করা হয়। রোহিঙ্গাদের জন্য গত দু'বছর ধরে ভারত যে মানবিক ত্রাণ পাঠিয়ে আসছে তার জন্য ধন্যবাদও জানায় বাংলাদেশ।
কিন্তু এগুলোও কোনোটাই বিশেষ নতুন কোনো কথা নয়। বরং রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে চাপ দেয়ার প্রশ্নে ভারতের কাছ থেকে যে আরও বলিষ্ঠ ভূমিকা বাংলাদেশ আশা করছিল, তা তেমন পূর্ণ হয়েছে বলে মনে হয় না।
ভারত এক্ষেত্রে তার দুই বন্ধু দেশ, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে একটা ভারসাম্যের নীতি নিয়েই এতকাল চলেছে - শেখ হাসিনার এই সফরেও দিল্লির সেই মনোভাবেরই প্রতিফলন হয়েছে।
এনআরসি বিতর্ক:
ভারত ও বাংলাদেশ যৌথ বিবৃতিটি জারি করেছে, সেই সুদীর্ঘ বয়ানের কোথাও এনআরসি শব্দটির উল্লেখ নেই।
ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন, আমরা তো বরাবরই বলে আসছি জাতীয় নাগরিকপঞ্জী বা এনআরসি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তাহলে আন্তর্জাতিক স্তরের একটি যৌথ বিবৃতিতে কেন তার উল্লেখ থাকতে যাবে?
কূটনৈতিক যুক্তি হিসেবে হয়তো ঠিকই আছে কিন্তু ঘটনা হল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন এনআরসি নিয়ে বাংলাদেশের দুশ্চিন্তার কিছু নেই- এই আশ্বাসটা সরাসরি প্রধানমন্ত্রী মোদির মুখ থেকে আসুক।
সপ্তাহখানেক আগে নিউইয়র্কে দুজনের বৈঠকের পর নরেন্দ্র মোদিকে উদ্ধৃত করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, তিনি শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করেছেন, এতে বাংলাদেশের উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কিছু নেই।
এই কথাটাই দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজে বলুন, বা ভারত সরকার অন্য কোনোভাবে প্রকাশ্যে জানাক - এটাই ছিল বাংলাদেশের প্রত্যাশা। সেটাও কতটুকু হলো, দেখার বিষয়।
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বা অন্যান্য বিজেপি নেতারা যেভাবে ক্রমাগত হুমকি দিয়ে চলেছেন এনআরসি-বাতিলদের বাংলাদেশেই ডিপোর্ট করা হবে, সেই পটভূমিতে এটা ছিল বাংলাদেশের জন্য জরুরি।
বিষয়টি নিয়ে দুই প্রধানমন্ত্রীর একান্তে কথাও হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত যৌথ বিবৃতিতে প্রসঙ্গটির কোনো উল্লেখ না-থাকায় এনআরসি প্রশ্নে বাংলাদেশের অস্বস্তি কাটল, এটাও কিন্তু বলা যাচ্ছে না।
সন্ধ্যায় ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবদান রাখায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্য এশিয়াটিক সোসাইটির ঠাকুর পিস অ্যাওয়ার্ড-২০১৮ লাভ করেন।
স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় ভারতের নয়াদিল্লির হোটেল তাজমহলে প্রধানমন্ত্রীর হাতে এ পুরস্কার তুলে দেয় কলকাতা ভিত্তিক সংস্থা দ্য এশিয়াটিক সোসাইটি। পরে প্রধানমন্ত্রীকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন সোসাইটির নেতারা। পুরস্কার গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে ধন্যবাদ জানিয়ে, শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাকি বিশ্বকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান শেখ হাসিনা।
দুপুরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক বিশ্ববাসীর কাছে সু-প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কের দৃষ্টান্ত– এ কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দুই দেশের মধ্যকার এ সম্পর্ক ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বিশ্ব সম্প্রীতিতে অনন্য নজির। নয়াদিল্লির হায়দ্রাবাদ হাউসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে যৌথভাবে তিনটি প্রকল্প উদ্বোধন অনুষ্ঠান শেষে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে এসব কথা বলেন।
এর আগে দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে দু'দেশের সাতটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয় এবং বৈঠক শেষে দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে চুক্তি ও সমঝোতাপত্র বিনিময় হয়। এছাড়া দুই প্রধানমন্ত্রী যৌথভাবে দ্বিপাক্ষিক তিনটি প্রকল্পও উদ্বোধন করেন।
ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যৌথভাবে খুলনায় অবস্থিত ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইনজিনিয়ার্সে বাংলাদেশ-ভারত প্রফেশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট (বিআইপিএসডি); রামকৃষ্ণ মিশন, ঢাকায় বিবেকানন্দ ভবন উদ্বোধন ও বাংলাদেশ থেকে ত্রিপুরায় এলপিজি আমদানি প্রকল্পের উদ্বোধন করেন দুই প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও পানিসম্পদ বিষয়ে ছয়টি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে দুই দেশের মধ্যে।
দুপুরে নয়াদিল্লির হায়দ্রাবাদ হাউসে বৈঠকে বসেন শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি। এরপর তাদের উপস্থিতিতেই সাত চুক্তি সই হয়। এ সময় দুই দেশের সরকারপ্রধানরা তিনটি যৌথ প্রকল্পের উদ্বোধন করেন।
শেখ হাসিনা হায়দ্রাবাদ হাউসে পৌঁছালে প্রধান ফটকে গিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান নরেন্দ্র মোদি। এরপর দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শুরু হয়। ১০ দিনের মধ্যে দুই দেশের দুই শীর্ষ নেতার এটি দ্বিতীয় বৈঠক। জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদে শেখ হাসিনা ও মোদির বৈঠক হয়। বৈঠকের পর হায়দরাবাদ হাউসে শেখ হাসিনা তাঁর সম্মানে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দেয়া মধ্যাহ্ন ভোজে অংশ নেন।
সমঝোতা স্মারকগুলো হলো:
উপকূলীয় এলাকায় নজরদারিতে সহযোগিতা বিনিময়ে একটি সমঝোতা স্মারকে সই করেছে বাংলাদেশ ও ভারত। সই করা সমঝোতা স্মারকের আওতায় বাংলাদেশের ফেনী নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করতে পারবে ভারত। এ পানি তারা ত্রিপুরা রাজ্যর সাবরুম শহরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ প্রকল্পে ব্যবহার করবে। চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর দিয়ে ভারতীয় পণ্য পরিবহনের বিষয়ে একটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) সই হয়েছে। বাংলাদেশকে দেয়া ভারতের ঋণের প্রকল্প বাস্তবায়নে একটি চুক্তি হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ইউনিভার্সিটি অব হায়দ্রাবাদের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।